তৃতীয় পক্ষ কর্তৃপক্ষ

তৃতীয় পক্ষ কর্তৃপক্ষ

২০০৬ সাল। অনার্স পড়তে প্রথম ঢাকা আসি। এসেই বুঝলাম শুধু পড়াশুনা করলে আমার হবে না। নিজের খরচ চালানোর মতো আয় আমাকে করতে হবে। তাই দেরি না করে ডাইরি খুলে মামাদের তালিকা করতে বসলাম। কারন, তখনই আমি জানতাম, মামা ছাড়া চাকরি হয় না। দুই জন মামার নাম তালিকা করতে পারলাম। একজন মায়ের ভাই অন্যজন মামির ভাই। মায়ের ভাই মামার কাছে চাকরি না পেলেও বাসায় থাকার ব্যবস্থা হল। মামার বাড়ি থাকার ব্যবস্থা না হলে ঢাকায় টিকে থাকা আমার জন্য কঠিন হতো। আর মামির ভাই মামা একটি সার্ভে প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে আমার প্রয়োজনটাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে মামাদের সামনে উপস্থাপনের জন্য নানি আর মামীকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ব্যবহার করলাম। প্রথমবারই ব্যক্তিগত পিআর কৌশল ব্যবহার করে আমি শতভাগ সফল হই। 

এরপর দেখলাম সার্ভে প্রতিষ্ঠানে সব সময় কাজ থাকে না। তাই আবার ডাইরি নিয়ে বসলাম। আর কোন মামা আছে কিনা? মামা নাই, আচ্ছা মামার বন্ধুও তো মামা, তাহলে মামার বন্ধু আছে কারা কারা, বড় ভাই, বড় ভাইয়ের বন্ধু তার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, তাদের আত্মীয়, এলাকার পরিচিতজন, নিজের বন্ধুদের মধ্যে কাদের সক্ষমতা আছে আমাকে চাকরি দেওয়ার। তালিকায় তাদের কারো নামই বাদ দিলাম না। এরপরে এদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। অনেকেই চাকরি দিয়েছেন। এভাবে চাকরি পাওয়া যায়। অন্যের মনের মধ্যে নিজের (আমার) সম্পর্কে পজিটিভ ধারনা তৈরি করে দেওয়া যায়। এই এক আইডিয়াতেই ১২ বছর ধরে ব্যবসা করছি কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই। যে ব্যবসাটি করছি সেটিও একটি পাবলিক রিলেশন এজেন্সি। নিজের জন্য যা করছি এখন প্রফেশনালি অন্য প্রতিষ্ঠানকেও তাই করে দিচ্ছি। 

এখনকার সময়ে, সফল মানুষেরা সোস্যাল লাইফ কিংবা প্রফেশনাল লাইফ সব জায়গাতেই জনসম্পর্ক (পাবলিক রিলেশন বাংলায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ জনসংযোগ। আমার কাছে জনসম্পর্ক শব্দটি সব থেকে পছন্দের ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়।) ব্যবস্থাপনার নানা কৌশলগুলো ব্যবহার করেন। আসলে জীবনে প্রতিটি দিনই জনসম্পর্ক ব্যবস্থাপনা দরকার এবং আপনি তা করেও আসছেন। 

আপনি ছাত্র হলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য পিআর দরকার। প্রেম বা বিয়ে করার জন্য পিআর দরকার, ভালো চাকরির জন্য, ভালো ব্যবসায়ের জন্য, বড় নেতা হওয়ার জন্য এমন কি নোবেল পুরষ্কার বা সেলাই মেশিন পাওয়ার জন্য মনোনীত হতে চাইলেও জনসংযোগ আপনার লাগবেই। জনসংযোগ বোঝেন বা না বোঝেন আপনি প্রতিদিন নানাভাবে জনসংযোগ করে আসছেন।

প্রশ্ন হলো কীভাবে করছেন? 

ধরুন, আপনি একজন বিবাহযোগ্য পাত্র। একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার বিবাহের আলোচনা চলছে। এবার আপনার পরিবারের লোকজন মেয়ের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা অফিস কলিগদের কাছ থেকে পাত্রীর সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। এ ঘটনা নতুন কিছু না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন মানুষদের কাছ থেকেও খোঁজ নেন যাদের আপনার পরিবারের লোক চেনেনই না। এই অপরিচিত প্রতিবেশি কিংবা অফিস কলিগদের কথা বিশ্বাস করে বিয়ের সিন্ধান্ত নেন আপনার পরিবার। পাত্রীর বেলাতেও একই ঘটনা ঘটে। পাত্র পক্ষ কিংবা পাত্রী পক্ষ পরিচিত আত্মীয় স্বজনদের থেকে অপরিচিত লোকদেরকেও বেশি বিশ্বাস করেন। এটাই হলো ‘তৃতীয় পক্ষ কর্তৃপক্ষ’ যার ব্যবহারিক নাম পাবলিক রিলেশন (পিআর) বাংলায় জনসংযোগ। এডওয়ার্ড বার্নেসকে বলা হয় ফাদার অব পিআর। ১৯২০ সালে তিনি প্রথমবার ব্যাখ্যা করেন- তৃতীয় পক্ষ কর্তৃপক্ষ কি?

এটাই ব্যক্তিগত জীবন থেকে এবার ব্যবসায়ে মিলান। আর আত্মীয়-স্বজন সীমিত সংখ্যা থেকে এবার অসীম ক্রেতার কথা চিন্তা করুন। তাহলে ভাবুন এবার যোগাযোগ কৌশন কেমন হবে?

ধরুন, আপনার পরিচিত কোন দোকানের সামনে দাড়িয়ে কোন ব্র্যান্ডের সাবান কিনবেন তাই ভাবছেন? এই পরিস্থতিতে সিন্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচিত দোকানদারের থেকে অপরিচিত ক্রেতার কথাই বেশি বিশ্বাস করেন। গবেষনা বলছে, এই পরিস্থিতিতে ৭০% লোক অপরিচিত লোকের কথা বিশ্বাস করেন। অন্যদিকে এডলম্যান পরিচালিত একটি জরিপে তিনি বলেছেন- ৫৫% মানুষ নিজের পছন্দের ব্র্যান্ড কিনতে পরিচিতদের উদ্বুদ্ধ করেন। এই ৭০% এবং ৫৫% লোককে পণ্যের প্রমোটার বানানো সম্ভব যদি তাদেরকে নিজের পন্য সম্পর্কে একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প বিশ্বাস করানো যায়।

তাই আমার কাছে জনসংযোগ হচ্ছে, সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই একবিংশ শতকে ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী না করে ব্র্যান্ড পজিশনিং করা সম্ভব না। তবে মনে রাখতে হবে, জনসংযোগ/জনসম্পর্ক কখনই আকর্ষণীয় বাক্যাংশ বা চাটুকারিতা নয়। 

রবার্ট ওয়াইন আমার খুব প্রিয় একজন জনসংযোগ পরামর্শদাতা। তার একটি কথা আমি কখনই ভুলবনা,“ বিজ্ঞাপন হচ্ছে আপনি যার জন্য নগদ প্রদান করেন, পিআর হচ্ছে যার জন্য আপনি প্রার্থনা করেন’। এটিই জনসংযোগে জন্য যথার্থ শব্দ।

আমেরিকার পাবলিক রিলেশনস সোসাইটি বলছেন, ‘জনসংযোগ হচ্ছে একটি কৌশলগত যোগাযোগ পদ্ধতি যা পারস্পরিক উপকারী সম্পর্ক তৈরি করে প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ক্রেতার মধ্যে।’ 

এখানে পাবলিক মানে ক্রেতা, বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়িক অংশীদার, কর্মচারী, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম (যারা এখনো ক্রেতা নয়)।

বিজ্ঞাপন ও জনসংযোগ নিয়ে কিছু ভুল বোঝা বুঝি

বিজ্ঞাপন একটি পণ্য এটি কেনা যায়। এটি শতভাগ বিনিময় সাপেক্ষ। বিজ্ঞাপন জনসম্মুখে চমকপ্রদভাবে প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপন সব সময় ক্রয়ের দিকে প্রভাবিত করে। এটি পণ্যের দ্রুত ক্রেতা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে জনসম্পর্ক কোন পণ্য না, জনসম্পর্ক কার্যক্রম ক্রেতার আস্থা ও বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য করা হয়। জনসম্পর্ক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পণ্যের প্রতি আনুগত্য তৈরিতে প্রভাবিত করে। এর মাধ্যমে ব্র্যান্ডের সাথে ক্রেতাদের একটা দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ক তৈরি হয়।  

বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষন করা, জনসম্পর্কের উদ্দেশ্য ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। বিজ্ঞাপনের ভাষার ধরন আকর্ষণমূলক, জনসম্পর্কের ভাষার ধরন সম্পর্ক স্থাপন মূলক।

যতক্ষণ মানুষ সঠিক ভাবে কোন মানুষের সাথে মানসিক বা ইমোশনালি সংযোগ স্থাপন করতে পারে না, ততক্ষণ সে মানুষ বিশ্বাসের সম্পর্ক হয়ে ওঠে না। যখন মানুষ সঠিক কৌশলে একটু খানি কানেক্ট করতে পারেন তখন অপর পক্ষ অনেকখানি আস্থাশীল/বিশ্বাসি হয়ে ওঠে।

মনে করে দেখুন, যখন টেলিভিশন দেখেন তখন সংবাদ, অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন দেখেন আবার যখন সংবাদপত্র পড়েন তখন নিউজ, ফিচার এবং বিজ্ঞাপন পড়েন। আমি আশা করছি আপনি মনে করতে পারবেন বিজ্ঞাপনগুলোর কথা, শব্দ, ডিজাইন সবই খুব চমকপ্রদ, আকর্ষণীয় ও কনভিন্সিং হয়। তাই নয় কি? কিন্তু প্রত্যেক ব্যাক্তি সংবাদ বিশ্বাস করেন।

কানেক্ট করতে না পারলে আপনি কাউকে কনভেন্স করতে পারবেন না। লোকে প্রথমেই দরকারি মানুষকে/কাস্টমারকে কনভেন্স করতে চায়। আসল সমস্যটা ওখানেই। হাতুরে ডাক্তার এই কাজটা করে বলেই রুগী পায়না। রোগ না ধরেই ঔষধ দেয়। আগে রোগ ধরতে হয় তার পরে ঔষধ দিতে হয়। একবার কানেক্ট করতে পারলে লোকে আপনা আপনিই কনভেন্স হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে জনসম্পর্কের ভাষা এবং মাধ্যমের পরিবর্তন হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে আলাদা আলাদা পন্থা। এই পরিবর্তন আগামী দিনেও চলতেই থাকবে।  

ক্রেতার আচরনের কিছু পরবর্তন

 

গত ৭০/৮০ বছরের মার্কেটিং (বিপনন) কৌশলে নানা ধরনের রূপান্তর হয়েছে। মার্কেটিংয়ের তিনটি বড় নীতির আর্বিভাব হয় এই সময়ের মধ্যেই। কোম্পানিগুলি প্রথমে পণ্য-কেন্দ্রীক এরপর ক্রেতা-কেন্দ্রীক তারপরে ক্রেতা থেকে মানব জাতি কেন্দ্রীক মার্কেটিং কৌশল ব্যাহার করেন। আরো একটু সহজ করে বললে বলতে হয়, ১৯৫০-১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, ১৯৭০-১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট এবং ১৯৯০-২০০০ সাল থেকে শুরু হয় ব্রান্ড ম্যানেজমেন্ট (তথ্যসূত্রঃ মার্কেটিং ৩.০, ফিলিপ কটলার)। এখন ২০২২ সাল। বিগ ডেটার সময়।  মার্কেটিংয়ের ধরন, ধারন, মাধ্যম সহ সব পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মূল কারণ, ক্রেতার ক্রয় আচরনের পরিবর্তন। 

সারা পৃথিবীর কর্পোরেট এখন ব্রান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। জনসংযোগ একটি দারুণ মাধ্যম কোন প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য।  ২০২২ সালে এসে আপনি যদি শুধু পণ্য কেন্দ্রীক বা কাস্টমার কেন্দ্রীক প্রমোশনাল প্লান করেন আর সেই প্লানে যদি আপনি সফল না হন, তখন হয়তো আপনি ভাগ্যের দোষ দিবেন? একটি প্রমোশন ভাগ্যের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে কোন সময়ে কোন কথা কার সাথে বলছেন তার উপরে। এখন ক্রেতা খুব সচেতন। আজকের দিনে ক্রেতারা শুধু ভালো পন্য হলেই কেনেন না। তারা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজ খবরও রাখেন। এ জন্যই এখন কোন কোম্পানি তার পন্য তৈরী করার জন্য পরিবেশ দূষণ করলে তাদের অনেক ভালো পণ্য হলেও ক্রেতারা সেটা প্রত্যাখান করেন। 

ঠিক এ কারনেই তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সারা বিশ্বে যারা, এইচঅ্যান্ডএম, হলমার্ক, কেলভিন ক্লিন ও ওয়ালমার্টের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কমে গিয়েছিল। ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল এইসব কম্পানি তাদের শ্রমিকদের ন্যায্য মূল্য প্রদান করে না এবং তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য কিছুই করেন না। সারা বিশ্বেই এরকম প্রতিবাদে বাধ্য হয়ে তাজরীন গার্মেন্টসকে ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন। জনসংযোগের প্রয়োজনীয়তা কোথায় উঠে এসেছে এটা আসলেই এখন ভাবার মতো ব্যাপার। এ গেল ক্রেতার সঙ্গে জনসংযোগ। 

প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কমিউনিকেশনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। শিল্প যুগে চাকরির নিরাপত্তা মানুষের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বাংলাদেশেও ১৯৭০-৮০ সাল পর্যন্ত চাকরির নিরাপত্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কিন্তু এখনকার সময়ে একজন ইমপ্লয়ি চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে আর ভাবেন না। কারণ প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে একজন ইমপ্লয়ি তার চাকরি পরিবর্তন করেন। এখন তারা অন্য কোন সুবিধা চায়। তাই জনসম্পর্ক করার আগে অবশ্য বিবেচনা করতে হবে কার সঙ্গে কোন কথা দিয়ে যোগাযোগ করা যাবে। আমার বউ যে কথায় খুশি হবে আমার ছেলের বউ সেই কথায় খুশি নাও হতে পারে। 

আজ সারা পৃথিবীতেই স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো তাদের ফান্ড পাওয়ার জন্য নানা ধরনের সম্মান জনক অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ এইসব অ্যাওয়ার্ড কারা পাচ্ছেন তাদের খোঁজ-খবর রাখেন যারা ফান্ড প্রদান করে সেইসব কোম্পানি। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলো তাদের শেয়ারহোল্ডারদের জন্যও জনসংযোগ করে থাকেন। এ কারণেই কোন কোন কোম্পানির শেয়ার কিনে মানুষ গর্বিত বোধ করেন। আবার কোন কোন কোম্পানির শেয়ার অনেক লাভ হলেও কিনতে চায় না। 

একটি কোম্পানি নানা ধরনের প্রয়োজনে জনসংযোগ করে থাকেন। তাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য একই ধরনের জনসংযোগ কৌশল নয়। 

জনসংযোগের মাধ্যম ও  মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক 

জনগণের ধরন বুঝে নির্বাচন করা হয় জনসংযোগের মাধ্যম। বেশিরভাগ মানুষ জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে শুধু প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেন। এখন সবাই সমান হারে সোস্যাল মিডিয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্যাংক তারাই শুধুমাত্র মিডিয়াতে কিছু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপানো, বছর শেষে একটি বাৎসরিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করা এবং কিছু লিফলেট ছাড়া খুব বেশি কিছু করেন বলে আমার মনে হয় না। বাধ্য হয়ে কোন কোন কর্মসূচিতে তারা স্পন্সর করেন। যে সব বেশির ভাগ সময়ই ব্যাংকের কোন কাজে লাগে না। আর যেখানে কাজে লাগবে সেখানে তারা স্পন্সর করে না। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর অবস্থান।

একটি সফল জনসংযোগের জন্য প্রথমে জানা দরকার কি বলতে চায়? কাকে বলতে চায়? এরপরে নির্বাচন করা দরকার কোন মাধ্যমে বলতে চাই। 

টার্গেট অডিয়েন্স যদি হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা, আর যদি বলতে চান ভালো কাজ করলে ইন্সেন্টিভ পাওয়া যাবে। তাহলে সব থেকে ভালো জনসংযোগের মাধ্যম তাদের জন্য ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা। অথবা তাদের ভালোর পরিমাপ নির্বাচন করে সেটাকে মেইলে জানানো। প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জনসংযোগ করতে চান তাহলে সব থেকে ভাল মাধ্যম ফ্যামিলি ডে, গেট টুগেদার অনুষ্ঠান করা অথবা গিফট পাঠানো। আর যদি বিনিয়োগ করেছে বা করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসংযোগ করতে চান তাহলে বছর শেষে লভ্যাংশের পরিমাণ এবং প্রাপ্তি অন্যান্য অ্যাচিভমেন্ট সমস্ত খবর তাদেরকে জানানো দরকার। মাধ্যম হিসেবে চিঠি বা মিডিয়া যথেষ্ট।

যদি ক্রেতার সঙ্গে জনসংযোগ করতে চান আর কোন অফার তাদেরকে জানাতে চান তাহলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ওয়েব এবং সোস্যাল মিডিয়া দারুন মাধ্যম। যদি ক্রেতাকে প্রোডাক্ট অভিজ্ঞতা দেওয়ার মাধ্যমে জনসংযোগ করতে চান তাহলে এবার কোন মিডিয়া নয়। দরকার ছোট ছোট ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রোডাক্ট স্যাম্পলিং করা বা ইনস্ট্যান্ট প্রোডাক্ট ইউজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এক্ষেত্রে ইভেন্ট ও এক্টিভেশান মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। এই মাধ্যমে বর্তমান ক্রেতাকে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা দেওয়া এবং ভবিষ্যৎ ক্রেতার মধ্যে ব্র্যান্ড অনুগত্য তৈরি সম্ভব।  

যদি ব্যক্তি হিসেবে নিজের জনসংযোগ করতে চান, আপনার কোন কাজে দক্ষতাে আছে সেটা জানাতে চান? তাহলে আপনার টার্গেট অডিয়েন্স ওই কাজ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। যারা আপনার কাজ কিনতে পারে। তাহলে মিডিয়া হিসাবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে লিংকডইন, নিজের সিভি, ওয়েবসাইট, সংশ্লিষ্ট ক্লাব বা অ্যাসোসিয়েশন, পাবলিক স্পিকিং, ব্লগিং, নিউজ পেপারে আর্টিকেল লেখা হতে পারে দারুন মাধ্যম।

এই আইডিয়াগুলো খুব ব্যাসিক লেভেলের। কিন্তু এই সব আইডিয়ার এ্যাডভান্স লেভেলে ব্যবহার করা সম্ভব ডিজিটাল মিডিয়ার জ্ঞান থাকে। কোন অডিয়েন্স কোন ভাবে কোন কথা শুনতে পছন্দ করে, সেটা যদি সঠিক ভাবে নির্বচন করতে পারেন, আপনি দক্ষ হাতে জনসংযোগ করতে পারবেন। তাই পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সঠিক জনসম্পর্ক তৈরী করার জন্য এই জ্ঞান অপরিহার্য।

অনেকেই বলতে শুনি যে, বিটিভিতে শুধু সরকারি সংবাদ দেখায়, শুধু সরকারকে প্রোমোট করে। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলতে পারি বিটিভি তৈরি হয়েছে সরকারের জনসংযোগের জন্য। সারা পৃথিবীতে সরকারি মিডিয়াগুলো সরকারের নিজের কথা প্রচারের জন্যই ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে এখন অনেক কর্পোরেট তাদের জনসংযোগের জন্য একটি মিডিয়া তৈরি করে রেখেছে। কারন, গণমাধ্যম যতো সহজে, যতোটা বিশ্বাস যোগ্য ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায় অন্যকোন মাধ্যমে অতো সহজে পৌঁছানো যায় না।

তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে জনসংযোগ কর্মকর্তার নিবিড় সম্পর্ক। গণমাধ্যম ক্রেতার এবং বিক্রেতার মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করে। তাই জনসংযোগ কর্মকর্তা গণমাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানের খবর প্রকাশ করতে এতো আগ্রহী। 

গণমাধ্যমের এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে আসলে আন্তঃনির্ভরশীল সস্পর্ক। সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসায় বিষয়ক তথ্য দরকার এবং ব্যবসা বিষয়ক কোন তথ্য পেলে প্রতিষ্ঠানের কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য দরকার। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও কিছু বিষয় জনগণকে জানাতে চায়। এ ভাবেই প্রয়োজনের তাগিদে দুই পক্ষের মধ্যে আন্তঃনির্ভরশীলতা তৈরী হয়। আবার গণমাধ্যমের সবথেকে বড় আয়ের হাতিয়ার বিজ্ঞাপন। 

জনসংযোগের গন্তব্য

ক্রেতার কাছে কোন তথ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য গণমাধ্যম একটি দারুন বাহন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য আরও সহজ রাস্তা। ডিজিটাল প্লাটফর্মের কারণে এখন বিক্রেতা কোন ক্রেতা সাধারণ পছন্দ, এখন আর অনুমান নয়, নিশ্চিত করে জানতে পারে। এ কাজটি করা হয় ক্রেতার  ক্রয় আচরনের ডেটা এনালাইসিস এর মাধ্যমে। 

আধুনিক মার্কেটিংয়ের জনক ফিলিপ কটলারের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা হলিউড সুপারদের থেকেও ইউটিউবারদের কথায় বেশি প্রভাবিত হয়। বিপনন কারীরাও এই কথার  সত্যতা হারে হারে বুঝতে পারছেন। আগে মানুষ সোস্যাল মিডিয়াতে কিছু প্রকাশহলে সে কথাটি বিশ্বাস করবে কি করবেনা তাই নিয়ে অনেক অনফিউসন ছিল। এখন আর সেই ককনফিউসন নেই। কারণ, মানুষ জানেন কেউ ভুল কোনো কথা বললে সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষতার প্রতিবাদ করবেন।

জ্ঞবেষনা আরো বলছে, ক্রয় সিন্ধান্ত নেয়ার আগে মানুষ এখন ‘এফ-ফ্যাক্টর’কে গুরুত্ব দিচ্ছে। ‘এফ-ফ্যাক্টর’ হচ্ছে এফ= ফ্যামেলি, এফ= ফেন্ডস, এফ= ফলোয়ার (আপনি যার ফলোয়ার)। এর পরেও মানুষ কোনো সিন্ধন্ত নেয়ার আগে সেই কোম্পানির রিভিউ দেখেন। তার পরে পন্য ক্রয়ের বা প্রতিষ্ঠানের ভালো বা মন্দের নিজের মনে একটি রিভিউ তৈরী করেন। ব্যাক্তির মনের এই রিভিউটার উপর নির্ভর করে (উপরে উল্লেকিত) ৭০% এবং ৫৫% হয়ে কাজ করবে কিনা। 

মিডিয়াতে একটি সংবাদ প্রকাশ হলে মানুষ বিশ্বাস করেন ঠিকই কিন্তু সব সময় টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর সম্ভব হয় না। আবার মিডিয়াতে সব সংবাদ প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু একটি ইউটিউবারের মাধ্যমে সহযে টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে একেবারে হাতের মাঠোই পৌঁছানো সম্ভব।           

ইউটিউবারদের মানুষকে প্রভাবিতো করার এই সক্ষমতা বেড়েই চলেছে। জ্ঞবেষনা বলছে এটা বাড়তেই থাকেবে। একারনেই আমার পিআর এজেন্সিতে নতুন একটি সার্ভিস চালু করেছি নাম- সোস্যাল ইনফ্লুন্সসার ম্যানেজমেন্ট। এর মাধ্যেমে কোম্পানির সঙ্গে ইউটিউবাদের সঙ্গে কানেক্ট করেদেই তখন ঔ ইউটিউবার সেই কোম্পানির পণ্য নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এই সেবাই আমার দারুন সারা পাচ্ছি। 

দেশ ডিজিটাল হচ্ছে সব কছুই এগিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের সাথে। মানুষের গভির সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে যন্ত্রের সাথে। তাই এখন মানুষের সাথে কোনো সম্পর্ক তৈরী করতে হলে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে কোন ডিজিটাল মাধ্যম। ডিজিটাল গণমাধ্যেমের সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে সোস্যাল মিডিয়াতেও। আর ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হতে হবে যে কোনো সময়ের থেকে বেশি সচেতন। তবেই হবে ভবিষৎ প্রজন্মের সাথে সঠিক জনসম্পর্ক।   

আমি আবার ডায়েরি নিয়ে বসেছি দশ, বিষ, ত্রিশ বা আরো বেশি সময় পরে করা আমার টার্গেট অডিয়েন্স তাদের তালিকা করছি। তাদের সঙ্গে ভাষার প্রয়োগ ও কোন মিডিয়া কিভাবে সম্পর্ক তৈরী করব তার জন্য কি কি শেখা দরকার তাও তালিকায় আনছি।           

জোবায়ের রুবেল

ফাউন্ডার এন্ড সিইও, স্টোরিটেলার পিআর 

যোগাযোগ: jobair@storyteller.team

জোবায়ের রুবেল পেশায় জনসংযোগ পরমর্শক। তিনি স্টোরিটেলার পিআর এর প্রতিষ্ঠাতা। জনসংযোগ নিয়ে কাজ করছেন দির্ঘ ১২ বছরে ধরে। সাংবাদিকতাও হরেছেন ৬ বছর। তিনি পড়াশনা করেছেন মার্কেটিংয়ে। যেহেতু তাকে ব্যাবসায়ের যোগাযোগ কৌশন নিয়ে আজ করতে হয় তাই পরে বিজসেন স্ট্যাটেজির ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ হতে। ভালোবাসেন সুখ-সুখি হওয়া নিয়ে কথা বলতে; বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলছেন ও নিয়মিত। নিয়মিত যাচ্ছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে। পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করছেন তাদের জীবন নিয়ে গতানুগতিক ধারণা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *